নতুন একটি ব্যবসা শুরু করার উত্তেজনাটাই অন্যরকম, তাই না? বিশেষ করে যখন আপনার সাথে এমন একজন অংশীদার থাকেন যাকে আপনি বিশ্বাস করেন। হোক সে আপনার বন্ধু, ভাই বা কোনো আত্মীয়। এই বিশ্বাসের উপর ভর করেই কিন্তু বড় বড় স্বপ্নের শুরু হয়। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শুধু বিশ্বাসের উপর ভর করে ব্যবসা চালালে একটা সময় পর সম্পর্ক এবং ব্যবসা দুটোই নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ব্যবসা মানেই লাভ-লোকসান, দায়িত্ব এবং টাকার হিসাব। আর এই হিসাব যখন মুখের কথায় থাকে, তখনই শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি। ঠিক এই কারণেই একটি “যৌথ ব্যবসার চুক্তিপত্র” বা “পার্টনারশিপ ডিড” হলো আপনার ব্যবসার প্রথম এবং প্রধান স্তম্ভ। এটি হলো আপনার ব্যবসার ‘সংবিধান’। এই পোস্টে আমি শুধু আপনাকে একটি চুক্তিপত্রের নমুনা (Sample) দেবো না। এর প্রতিটি অংশ সহজ করে বুঝিয়ে দেবো, যাতে আপনি আত্মবিশ্বাসের সাথে আপনার ব্যবসার প্রথম ধাপটি পার করতে পারেন।
যৌথ ব্যবসার চুক্তিপত্র কী?
খুব সহজ ভাষায় যদি বলি, যৌথ ব্যবসার চুক্তিপত্র হলো দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে সম্পাদিত একটি লিখিত অঙ্গীকার। এই দলিলে স্পষ্টভাবে লেখা থাকে যে আপনারা কী ব্যবসা করছেন। কে কত টাকা বিনিয়োগ করেছেন (মূলধন), ব্যবসার লাভ বা লোকসান হলে তা কীভাবে ভাগ হবে? এবং ব্যবসা পরিচালনায় কার কী দায়িত্ব থাকবে। এটি মূলত আপনাদের মধ্যকার সব শর্তের একটি লিখিত প্রমাণ। বাংলাদেশে ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুযায়ী এই চুক্তিপত্রটি মৌখিকও হতে পারে। কিন্তু একটি লিখিত ও নিবন্ধিত চুক্তিপত্র ছাড়া আপনি আইনিভাবে প্রায় পঙ্গু। তাই মুখের কথার কোনো আইনি ভিত্তি নেই, লিখিত চুক্তিই হলো আসল।
কেন প্রতিটি যৌথ ব্যবসার জন্য একটি লিখিত চুক্তিপত্র থাকা আবশ্যক?

আমি প্রায়ই একটা কথা বলি। ব্যবসা শুরুর আগে যখন সবকিছু ভালো থাকে, তখন চুক্তিপত্রের কথা বললে অনেকেই ভাবেন, “ওর কি আমাকে বিশ্বাস নেই?” সত্যি বলতে, চুক্তিপত্র করা হয় বিশ্বাস ভাঙার জন্য নয়। বিশ্বাসকে আজীবন টিকিয়ে রাখার জন্য। যখন সবকিছু লেখা থাকে, তখন আর ভুল বোঝার কোনো সুযোগ থাকে না।
আসুন দেখি, একটি লিখিত চুক্তিপত্র আপনাকে কীভাবে সাহায্য করে:
-
স্পষ্টতা তৈরি করে: কে মার্কেটিং দেখবে? কে হিসাব দেখবে? লাভ হলে কে কত শতাংশ পাবে? লোকসান হলে কী হবে?—এই সবকিছুর পরিষ্কার উত্তর থাকে চুক্তিপত্রে।
-
ভুল বোঝাবুঝি নিরসন করে: “তুমি তো এটা করতে চেয়েছিলে,” বা “আমার তো এত টাকা পাওয়ার কথা ছিল”—এই ধরনের মৌখিক বিতর্কের কোনো স্থান থাকে না। যেকোনো সমস্যায় আপনারা চুক্তিপত্রটি খুলে দেখতে পারেন।
-
আইনি সুরক্ষা দেয়: অংশীদারদের মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ দেখা দিলে এবং তা যদি আদালত পর্যন্ত গড়ায়, তবে এই লিখিত চুক্তিপত্রই হবে আপনার প্রধান আইনি হাতিয়ার।
-
ব্যাংকিং ও লাইসেন্স: আপনি যদি ব্যবসার নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে চান, লোন নিতে চান, বা ট্রেড লাইসেন্স করতে চান, তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ব্যাংক বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার কাছে এই পার্টনারশিপ ডিড দেখতে চাইবে।
-
ব্যবসার স্থায়িত্ব: ধরুন, কোনো অংশীদারের আকস্মিক মৃত্যু হলো বা কেউ অবসর নিতে চাইলেন। তখন কী হবে? চুক্তিপত্রে এর সমাধান লেখা থাকলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় না, বরং একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা চলতে থাকে।
একটি আদর্শ যৌথ ব্যবসার চুক্তিপত্রের মূল ধারা বা বিষয়সমূহ
একটি চুক্তিপত্রকে আপনি একটি বাড়ির প্ল্যানের সাথে তুলনা করতে পারেন। প্রতিটি ধারা হলো এক-একটি রুম, যার নির্দিষ্ট কাজ আছে। চলুন, একটি ভালো চুক্তিপত্রের মূল অংশগুলো (Clausess) দেখে নিই:
১. ব্যবসার মৌলিক তথ্য
এটি হলো আপনার ব্যবসার পরিচয়। এখানে স্পষ্ট করে লিখুন:
-
ব্যবসার নাম: আপনারা কী নামে ব্যবসাটি পরিচালনা করবেন।
-
ব্যবসার ধরণ: এটি কি কোনো পণ্য বিক্রি করবে, নাকি সেবা দেবে? (যেমন: রেস্টুরেন্ট, আইটি ফার্ম, ইত্যাদি)।
-
প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা: কোন ঠিকানায় ব্যবসার কার্যক্রম চলবে বা চিঠি চালাচালি হবে।
-
ব্যবসা শুরুর তারিখ ও মেয়াদ: কবে থেকে ব্যবসা শুরু হচ্ছে এবং এর কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে কি না (যেমন: ৫ বছরের জন্য)।
২. অংশীদারদের বিবরণ
এখানে আপনাদের সবার পরিচয় থাকবে। সকল অংশীদারের পূর্ণ নাম, পিতার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, পেশা, মোবাইল নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) নম্বর উল্লেখ করতে হবে।
৩. মূলধন সরবরাহ (Capital Contribution)
এটি খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কে কত টাকা বা কী সম্পদ দিয়ে ব্যবসা শুরু করছেন তার সুস্পষ্ট হিসাব এখানে থাকতে হবে।
-
কেউ হয়তো নগদ ৫ লক্ষ টাকা দিয়েছেন।
-
আরেকজন হয়তো নগদ দেননি, কিন্তু তার নিজের একটি দোকানঘর ব্যবসার জন্য দিয়েছেন, যার মূল্য ৫ লক্ষ টাকা।
-
আরেকজন হয়তো ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার বা যন্ত্রপাতি দিয়েছেন।
কে কীভাবে মূলধন দিচ্ছেন, তার আর্থিক মূল্য কত, তা এখানে শতাংশ (%) উল্লেখসহ লিখে রাখা বাধ্যতামূলক।
৪. লাভ-লোকসান বন্টন (Profit & Loss Distribution)
ব্যবসা তো লাভের জন্যই করা, তাই না? কিন্তু লোকসানও ব্যবসারই অংশ। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, লাভ ভাগাভাগি নিয়ে যত না সমস্যা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় লোকসানের দায়িত্ব কে নেবে তা নিয়ে। তাই এই ধারায় খুব পরিষ্কার করে লিখুন:
-
লাভ হলে তা মূলধনের অনুপাতে ভাগ হবে, নাকি সমান ভাগে ভাগ হবে?
-
লোকসান হলে তার দায় কে কীভাবে বহন করবেন?
৫. অংশীদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য (Roles & Responsibilities)
“সবাই মিলে ব্যবসা দেখবো” এই কথাটি ব্যবসার জন্য খুবই ক্ষতিকর। শুরু থেকেই ঠিক করে নিন কার কী কাজ।
-
কে প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা দেখবেন (Managing Partner)?
-
কে ব্যাংক ও আর্থিক হিসাব দেখবেন?
-
কে মার্কেটিং ও সেলস-এর দায়িত্বে থাকবেন?
-
কার কী ক্ষমতা থাকবে (যেমন: কে কত টাকা পর্যন্ত খরচ করার সিদ্ধান্ত একা নিতে পারবেন)?
৬. বেতন, ভাতা ও উত্তোলন (Salary, Allowances & Drawings)
অংশীদাররা কি ব্যবসা থেকে মাসিক কোনো বেতন পাবেন? পেলে কত টাকা? নাকি শুধু লাভের অংশই পাবেন? ব্যবসার টাকা মানেই কিন্তু নিজের টাকা নয়। তাই, কোনো অংশীদার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবসা থেকে টাকা তুলতে (Drawings) পারবেন কি না, পারলেও তার সীমা কত এবং তা কীভাবে ফেরত দিতে হবে, তা এখানে স্পষ্ট করুন।
৭. ব্যাংক হিসাব পরিচালনা (Bank Account Operation)
ব্যবসার নামে একটি যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (Joint Bank Account) খুলতে হবে। সেই অ্যাকাউন্টের টাকা লেনদেনের জন্য চেকে কার কার স্বাক্ষর লাগবে? যেকোনো একজন নাকি নির্দিষ্ট দুজন অংশীদারের যৌথ স্বাক্ষরে টাকা তোলা যাবে তা এখানে নির্ধারণ করুন।
৮. নতুন অংশীদার গ্রহণ ও পুরাতন অংশীদারের অবসর/মৃত্যু
যদি ভবিষ্যতে নতুন কাউকে অংশীদার হিসেবে নিতে চান, তার নিয়ম কী হবে? অথবা কোনো পুরাতন অংশীদার যদি চলে যেতে চান (অবসর), তাকে কীভাবে তার পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হবে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কোনো অংশীদারের মৃত্যু হলে তার অংশ কি তার উত্তরাধিকারী (Heir) পাবেন, নাকি বাকি অংশীদাররা তা কিনে নেবেন? এই কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর আগেই ঠিক করে রাখলে ভবিষ্যৎ মসৃণ হয়।
৯. বিরোধ নিষ্পত্তি (Dispute Resolution)
মানুষ এক হলে মতের অমিল হবেই। ঝগড়া বা বিরোধ দেখা দিলে আপনারা কি প্রথমেই আদালতে যাবেন? নাকি প্রথমে নিজেরা বসে বা তৃতীয় কোনো পক্ষের (Mediator) মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করবেন? এই প্রক্রিয়ার উল্লেখ থাকাটা খুব জরুরি।
১০. ব্যবসা বিলোপ (Dissolution of Firm)
যেকোনো কারণেই হোক, যদি ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয় (বিলোপ), তার প্রক্রিয়া কী হবে? কীভাবে ব্যবসার সব সম্পদ বিক্রি করে দেনা (Liability) পরিশোধ করা হবে এবং তারপর টাকা অবশিষ্ট থাকলে তা অংশীদাররা কীভাবে ভাগ করে নেবেন তার সুস্পষ্ট নিয়ম এখানে থাকতে হবে।
যৌথ ব্যবসার চুক্তিপত্র নমুনা (টেমপ্লেট)

এখানে আমি আপনাকে একটি সাধারণ খসড়া বা নমুনা দিচ্ছি। এটি আপনাকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেবে। একটি জরুরি সতর্কবার্তা (Disclaimer):
আমি আপনাকে যে নমুনাটি দিচ্ছি, এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ ধারণা মাত্র (Basic Sample)। প্রতিটি ব্যবসার ধরণ, শর্ত এবং জটিলতা ভিন্ন হয়। এই নমুনাটি কোনোভাবেই আইনি পরামর্শের বিকল্প নয়। আমি জোরালোভাবে সুপারিশ করছি, আপনার ব্যবসার ধরণ অনুযায়ী একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী বা লিগ্যাল অ্যাডভাইজরের সাহায্য নিয়ে চূড়ান্ত চুক্তিপত্রটি তৈরি করুন। একটি ভালো চুক্তিপত্র তৈরি করা হলো ব্যবসার খরচ নয়, বরং এটি আপনার সেরা ‘বিনিয়োগ’।
[নমুনা শুরু]
অংশীদারি ব্যবসার চুক্তিপত্র (Partnership Deed)
এই চুক্তিপত্রটি আজ [তারিখ, মাস, বছর, যেমন: ১৭ই নভেম্বর, ২০২৫] তারিখে, [স্থান, যেমন: ঢাকা] বসে নিম্নোক্ত পক্ষগণের মধ্যে সম্পাদিত হলো:
প্রথম পক্ষ (অংশীদার-১):
নাম: …
পিতার নাম: …
স্থায়ী ঠিকানা: …
বর্তমান ঠিকানা: …
জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর: …
মোবাইল: …
দ্বিতীয় পক্ষ (অংশীদার-২):
নাম: …
পিতার নাম: …
স্থায়ী ঠিকানা: …
বর্তমান ঠিকানা: …
জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর: …
মোবাইল: …
(যদি আরও অংশীদার থাকেন, তবে “তৃতীয় পক্ষ”, “চতুর্থ পক্ষ” হিসেবে যুক্ত করুন)
যেহেতু পক্ষগণ যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সম্মত হয়েছেন, সেহেতু অদ্য নিম্নোক্ত শর্তাবলির ভিত্তিতে এই অংশীদারি চুক্তিপত্র সম্পাদিত হলো:
ধারা ১: ব্যবসার নাম ও ঠিকানা
অত্র চুক্তিপত্রের অধীনে পরিচালিত ব্যবসার নাম হইবে “[ব্যবসার নাম লিখুন, যেমন: ক খ ট্রেডার্স]” এবং এর প্রধান কার্যালয় “[ব্যবসার ঠিকানা লিখুন]”-এই ঠিকানায় অবস্থিত হইবে। প্রয়োজনে পক্ষগণের সর্বসম্মতিক্রমে অন্যত্র শাখা অফিস খোলা যাইবে।
ধারা ২: ব্যবসার ধরণ
এই ব্যবসাটি মূলত একটি [ব্যবসার ধরণ, যেমন: আইটি সেবা প্রদানকারী / রেস্টুরেন্ট / ই-কমার্স] প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হইবে।
ধারা ৩: ব্যবসার মেয়াদ ও শুরুর তারিখ
এই ব্যবসাটি অদ্য [তারিখ] হইতে শুরু হইয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য বলবৎ থাকিবে। (অথবা: … তারিখ পর্যন্ত বলবৎ থাকিবে)।
ধারা ৪: মূলধন সরবরাহ
এই ব্যবসায়ের মোট প্রাথমিক মূলধন হইবে [মোট টাকার পরিমাণ] টাকা। উক্ত মূলধন পক্ষগণ নিম্নোক্তভাবে সরবরাহ করিয়াছেন/করিবেন:
-
প্রথম পক্ষ: [টাকার পরিমাণ] টাকা (মোট মূলধনের …%)
- দ্বিতীয় পক্ষ: [টাকার পরিমাণ] টাকা (মোট মূলধনের …%)(যদি কেউ টাকা ছাড়া অন্য কিছু দেন, তা এখানে উল্লেখ করুন, যেমন: “দ্বিতীয় পক্ষ নগদ … টাকা এবং … মূল্যের একটি কম্পিউটার সরবরাহ করিয়াছেন।”)
ধারা ৫: লাভ-লোকসান বন্টন
ব্যবসায়ের বাৎসরিক নিরীক্ষা (Audit) শেষে অর্জিত নীট লাভ (Net Profit) বা লোকসান (Loss) পক্ষগণের মধ্যে নিম্নোক্ত অনুপাতে বন্টিত হইবে:
-
প্রথম পক্ষ: …% (শতাংশ)
-
দ্বিতীয় পক্ষ: …% (শতাংশ)
ধারা ৬: দায়িত্ব ও কর্তব্য
(এখানে বিস্তারিত লিখুন… যেমন: “প্রথম পক্ষ ব্যবসার সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকিবেন এবং দ্বিতীয় পক্ষ মার্কেটিং ও সেলস-এর দায়িত্বে থাকিবেন।”)
ধারা ৭: বেতন ও উত্তোলন
ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোনো পক্ষই মাসিক বেতন বা ভাতা পাইবেন না (অথবা: “…পক্ষ মাসিক … টাকা বেতন পাইবেন”)। তবে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে মাসে সর্বোচ্চ […টাকা] উত্তোলন করা যাইবে, যা বাৎসরিক লাভের অংশ হইতে সমন্বয় করা হইবে।
ধারা ৮: ব্যাংক হিসাব
ব্যবসার নামে যেকোনো তফসিলি ব্যাংকে একটি যৌথ ব্যাংক হিসাব খোলা হইবে। উক্ত হিসাব প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হইবে।
ধারা ৯: বিরোধ নিষ্পত্তি
পক্ষগণের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তা প্রথমে আপোষ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হইবে। তাহাতে সমাধান না হইলে একজন মধ্যস্থতাকারীর (Mediator) মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হইবে। তাহাতেও ব্যর্থ হইলে পক্ষগণ বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারিবেন।
ধারা ১০: ব্যবসা বিলোপ
(এখানে ব্যবসা বন্ধ করার শর্তগুলো লিখুন… যেমন: সকল অংশীদারের সম্মতিতে বা লোকসানের কারণে…)
অত্র চুক্তিপত্রের সকল শর্ত পক্ষগণ পড়িয়া, বুঝিয়া, সুস্থ মস্তিষ্কে ও অন্যের প্ররোচনা ব্যতীত স্ব-স্ব সম্মতিতে স্বাক্ষর দান করিলেন।
সাক্ষীগণের স্বাক্ষর:
১. নাম ও ঠিকানা:
স্বাক্ষর:
২. নাম ও ঠিকানা:
স্বাক্ষর:
অংশীদারগণের স্বাক্ষর:
প্রথম পক্ষ:
(স্বাক্ষর)
দ্বিতীয় পক্ষ:
(স্বাক্ষর)
[নমুনা শেষ]
চুক্তিপত্র লেখার পর করণীয়
চুক্তিপত্রটি সই করলেই কিন্তু কাজ শেষ নয়। একে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য আরও কয়েকটি ধাপ বাকি আছে।
১. নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে প্রিন্ট করা
চুক্তিপত্রটি অবশ্যই নির্ধারিত মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পেপারে প্রিন্ট করতে হবে। অংশীদারি ব্যবসার মূলধনের উপর ভিত্তি করে এই স্ট্যাম্পের মূল্য নির্ধারিত হয় (সাধারণত ২০০০ টাকা বা তার বেশি হতে পারে)। এই বিষয়টি একজন আইনজীবীর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নেবেন।
২. নোটারি পাবলিক
সকল অংশীদার এবং সাক্ষীগণের স্বাক্ষর সম্পন্ন হওয়ার পর, এই চুক্তিপত্রটি একজন নোটারি পাবলিকের (Notary Public) মাধ্যমে সত্যায়িত করে নিন। এটি দলিলের সত্যতা বৃদ্ধি করে।
৩. রেজিস্ট্রেশন (ঐচ্ছিক কিন্তু সবচেয়ে জরুরি)
অনেকেই এই ধাপটি এড়িয়ে যান খরচ বাচানোর জন্য, কিন্তু আমি বলবো, এটিই সবচেয়ে বড় ভুল। ১৯৩২ সালের আইন অনুযায়ী পার্টনারশিপ ডিড রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু এটি না করলে আপনি আইনগতভাবে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) করা ও না করার পার্থক্য:
| বৈশিষ্ট্য | নিবন্ধিত (Registered) চুক্তিপত্র | অনিবন্ধিত (Unregistered) চুক্তিপত্র |
| আইনি ভিত্তি | অত্যন্ত শক্তিশালী। আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য। | খুবই দুর্বল। এর আইনি ভিত্তি প্রায় নেই। |
| তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা | ব্যবসার নামে অন্য কোনো পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। | ব্যবসার নামে অন্য কারো বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। |
| নিজেদের মধ্যে মামলা | একজন অংশীদার অন্য অংশীদারের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের মামলা করতে পারে। | অংশীদাররা একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না। |
| ব্যাংক লোন | ব্যাংক লোন বা বড় বিনিয়োগ পেতে সহজ হয়। | ব্যাংক লোন বা বিনিয়োগ পেতে অত্যন্ত কঠিন হয়। |
কোথায় রেজিস্ট্রেশন করবেন?
আপনার ব্যবসার প্রধান কার্যালয় যে জেলায় অবস্থিত, সেই জেলার রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (RJSC) অফিস থেকে এই চুক্তিপত্রটি নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রি করতে হয়।
প্রশ্ন ১: যৌথ ব্যবসার চুক্তিপত্র কি রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক?
উত্তর: না, আইনত বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, রেজিস্ট্রেশন না করাটা আপনার ব্যবসার জন্য একটি ‘টাইম বোমা’ সেট করে রাখার মতো। রেজিস্ট্রেশন করা না থাকলে আপনি অন্য কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে বা এমনকি নিজের অংশীদারের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন না।
প্রশ্ন ২: কত টাকার স্ট্যাম্পে পার্টনারশিপ ডিড লিখতে হয়?
উত্তর: এটি আপনার ব্যবসার মোট মূলধনের উপর নির্ভর করে। স্ট্যাম্প ডিউটি একটি পরিবর্তনশীল বিষয়। আমার পরামর্শ হলো, একজন আইনজীবীর সাথে কথা বলুন, তিনি আপনাকে আপনার মূলধন অনুযায়ী সঠিক টাকার পরিমাণ বলে দিতে পারবেন।
প্রশ্ন ৩: চুক্তিপত্র না করলে কী কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর: চুক্তিপত্র না থাকলে ব্যবসার লাভ-লোকসান ভাগাভাগি, দায়িত্ব বন্টন, এমনকি ব্যবসার মালিকানা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় কথা, সম্পর্কের অবনতি হলে আপনি কোনো আইনি সুরক্ষাই পাবেন না এবং আপনার সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে।
প্রশ্ন ৪: চুক্তিপত্র কি পরে পরিবর্তন করা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, অবশ্যই যায়। ব্যবসার প্রয়োজনে যদি কোনো শর্ত পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করার দরকার হয়, তবে সকল অংশীদারের সম্মতিতে একটি “পরিপূরক চুক্তিপত্র” (Supplementary Deed) সম্পাদন করে মূল চুক্তিপত্রের সাথে তা যুক্ত করে নিলেই হবে।
আমার শেষ কথা
ব্যবসা হলো একটি সম্পর্কের মতোই। আর প্রতিটি ভালো সম্পর্কের ভিত্তি হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং স্পষ্টতা। একটি লিখিত চুক্তিপত্রই পারে সেই স্পষ্টতা নিশ্চিত করতে। এটিকে শুধু একটি আইনি কাগজ হিসেবে দেখবেন না। এটি হলো আপনার স্বপ্ন, আপনার বিনিয়োগ এবং আপনার সম্পর্কের রক্ষাকবচ। সামান্য কিছু টাকা বাচানোর জন্য চুক্তিপত্র তৈরি করা থেকে বিরত থাকবেন না। একজন দক্ষ আইনজীবীর সাহায্য নিন এবং আপনার ব্যবসার ভিত্তিটি প্রথম দিন থেকেই মজবুত করে নিন। আপনার নতুন ব্যবসার জন্য রইলো অনেক শুভকামনা!
২০ হাজার টাকায় ২৫ টি ব্যবসার আইডিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য এখানে প্রবেশ করুন।